Ticker

200/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

Responsive Advertisement

প্রতিমা পূজো কি এবং কেন?

 


👉প্রতিমা পূজোর স্বরূপ জানতে হলে প্রথমে আমাদেরকে জানতে হবে ঈশ্বর ও দেবতা বলতে সনাতন দর্শনে কি বলা হয়েছে।

👉ঈশ্বর ও দেবতা

প্রথমেই বলে রাখা দরকার সনাতন দর্শনে বহু ঈশ্বরবাদের স্থান নাই। বরং আমরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। হিন্দু শাস্ত্র মতে, "ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়"। সনাতন দর্শন বলে, "ঈশ্বর স্বয়ম্ভূ" অর্থাৎ ঈশ্বর নিজে থেকে উৎপন্ন। তার কোন স্রষ্টা নাই। তিনি নিজেই নিজের স্রষ্টা।
আমাদের প্রাচীন ঋষিগণ বলে গিয়েছেন, "ঈশ্বরের কোন নির্দিষ্ট রূপ নেই (নিরাকার ব্রহ্ম)। তাই তিনি অরূপ, তবে তিনি যে কোন রূপেই অবস্থিত। তিনিই ব্রহ্মাণ্ড।"
ঋগ্বেদে বলা আছে, "ঈশ্বর একমেবাদ্বিতীয়ম"---- ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। ঈশ্বর বা ব্রহ্ম (ব্রহ্মা নন) সম্পর্কে আরও বলা হয়, "অবাংমনসগোচর"---- অর্থাৎ ঈশ্বরকে কথা (বাক), মন বা চোখ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি বাহ্য জগতের অতীত ।
ঈশ্বর সম্পর্কে ঋগ্বেদে বলা আছে, "একং সদ বিপ্রা বহুধা বদন্তি (ঋক-১/৬৪/৪৬)"---- অর্থাৎ সেই এক ঈশ্বরকে পণ্ডিতগণ বহু নামে বলে থাকেন।
"একং সন্তং বহুধন কল্পায়ন্তি (ঋক-১/১১৪/৫)"---- অর্থাৎ সেই এক ঈশ্বরকে বহুরূপে কল্পনা করা হয়েছে।
"দেবানাং পূর্বে যুগে হসতঃ সদাজায়ত (ঋক-১০/৭২/৭)"---- অর্থাৎ দেবতারও পূর্বে সেই অব্যাক্ত (ঈশ্বর) হতে ব্যক্ত জগত উৎপন্ন হয়েছে। ঈশ্বর এক কিন্তু দেবদেবী অনেক।
তাহলে দেব দেবী কারা?
👉মনে রাখতে হবে দেব দেবীগণ ঈশ্বর নন। ঈশ্বরকে বলা হয় নির্গুণ অর্থাৎ জগতের সব গুণের (quality) আধার তিনি।

আবার ঈশ্বর সগুণও। কারণ সর্ব শক্তিমান ঈশ্বর চাইলেই যে কোন গুনের অধিকারী হতে পারেন এবং সেই গুনের প্রকাশ তিনি ঘটাতে পারেন । দেব দেবীগণ ঈশ্বরের এই সগুণের প্রকাশ। অর্থাৎ ঈশ্বরের এক একটি গুণের সাকার প্রকাশই দেবতা। ঈশ্বর নিরাকার কিন্তু তিনি যে কোন রূপে সাকার হতে পারেন আমাদের সামনে; কারণ তিনি সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। যদি আমরা বিশ্বাস করি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান তাহলে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার গুণের প্রকাশ খুবই স্বাভাবিক। তাই ঈশ্বরের শক্তির সগুণ রূপ- দুর্গা, কালী, পার্বতী, বিদ্যার সগুণ রূপ সরস্বতী, ঐশ্বর্যের সগুণ রূপ লক্ষ্মী, মৃত্যুর রূপ যম। তেমনি ঈশ্বর যখন সৃষ্টি করেন তখন ব্রহ্মা ( ব্রহ্ম নয়), যখন পালন করেন তখন বিষ্ণু আর প্রলয়রূপে শিব।এজন্য বলা হয়ে থাকে ঈশ্বরই ব্রহ্মা, তিনিই বিষ্ণু, তিনিই শিব। তাহলে আমারা এখন বুঝতে পারছি দেব দেবী অনেক হতে পারে কিন্তু ঈশ্বর এক এবং দেবতাগণ এই পরম ব্রহ্মেরই বিভিন্ন রূপ । তাই হিন্দুরা বহু দেবপাসক (বস্তুত দেবপাসনা ঈশ্বর উপাসনাই) হতে পারে তবে বহু ঈশ্বরবাদী নন।
এতক্ষন আপনাদেরকে বললাম ঈশ্বর আর দেবতার পার্থক্য। এখন বলব তাহলে আমরা কেন এ সকল দেব দেবীগণের মূর্তি পূজা করি।
👉মূর্তি পূজার রহস্য

মানুষের মন স্বভাবতই চঞ্চল। পার্থিব জগতে আমাদের চঞ্চল মন নানা কামনা বাসনা দিয়ে আবদ্ধ। আমরা চাইলেই এই কামনা বাসনা বা কোন কিছু পাবার আকাংক্ষা থেকে মুক্ত হতে পারি না।(ধরুন একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষা জীবনের বাসনা থাকে পরীক্ষায় প্রথম হওয়া। এজন্য সে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর আরাধনা করে)। তীব্র গতির এই মনকে সংযত করা, স্থির করার ব্যবস্থা করা হয় এই সগুণ ঈশ্বরের বিভিন্ন রুপের মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে আমরা কখনই ঈশ্বরের বিশালতা বা অসীমতা কে আমদের সসীম চিন্তা দিয়ে বুঝতে পারব না। বরং সর্বগুণময় ঈশ্বরের কয়েকটি বিশেষ গুনকেই বুঝতে পারব। আর এ রকম এক একটি গুণকে বুঝতে বুঝতে হয়ত কোন দিন সেই সর্ব গুণময়কে বুঝতে পারব। আর মূর্তি বা প্রতিমা হল এসকল গুণের রূপকল্প বা প্রতীক। এটা অনেকটা গনিতের সমস্যা সমাধানের জন্য ‘x’ ধরা। আদতে x কিছুই নয় কিন্তু এক্স ধরেই হয়ত আমরা গনিতের সমস্যার উত্তর পেয়ে যাই। অথবা ধরুন জ্যামিতির ক্ষেত্রে আমরা কোন কিছু বিন্দু দিয়ে শুরু করি।
কিন্তু বিন্দুর সংজ্ঞা হল যার দৈর্ঘ, প্রস্থ ও বেধ নাই কিন্তু অবস্থিতি আছে – যা আসলে কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ এই বিন্দুকে আশ্রয় করেই আমরা প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা থেকে হিমালয়ের উচ্চতা সব মাপতে পারি। আবার ধরুন ভূগোল পড়ার সময় একটি গ্লোব রেখে কল্পনা করি এটা পৃথিবী আবার দেয়ালের ম্যাপ টানিয়ে বলি এটা লন্ডন, এটা ঢাকা, এটা জাপান। কিন্তু ঐ গ্লোব বা ম্যাপ কি আসলে পৃথিবী? অথচ ওগুলো দেখেই আমরা পৃথিবী চিনছি। তেমনি মূর্তির রূপ বা প্রতিমা স্বয়ং ঐসকল দেবতা নন তাঁদের প্রতীক, চিহ্ন বা রূপকল্প। এগুলো রূপকল্প হতে পারে কিন্তু তা মনকে স্থির করতে সাহায্য করে এবং ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ সম্পর্কে ধারণা দেয়, শেখায় ঈশ্বর সত্য। সব শেষে পরম ব্রহ্মের কাছে পৌছাতে সাহায্য করে।
হিন্দু ধর্মে পূজা একটি বৈশিষ্ট্য। কল্পনায় দাড়িয়ে সত্য উত্তরণই পূজার সার্থকতা। আমাদের ধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের উপাসনার বিধান আছে। নিরাকার ঈশ্বরের কোন প্রতিমা নাই, থাকা সম্ভবও না। যারা ঈশ্বরের অব্যক্ত বা নিরাকার উপাসনা করেন তাঁদের বলে নিরাকারবাদী। আর যারা ঈশ্বরের সাকার রূপের উপাসনা করেন তাঁরা সাকারবাদী।
এজন্য গীতায় বলা আছে, "যারা নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করেন তারাও ঈশ্বর প্রাপ্ত হন। তবে নির্গুণ উপাসকদের কষ্ট বেশি। কারণ নিরাকার ব্রহ্মে মনস্থির করা মানুষের পক্ষে খুবই ক্লেশকর।"
----(শ্রীমদ্ভগবদগীতা, ১২শ অধ্যায়, শ্লোক ৩,৪,৫)
তবে কি হিন্দুরা পৌত্তলিক?
অন্য অনেক লোকেরা সনাতন দর্শন সম্পর্কে না জেনেই মূর্তি পূজা দেখে মন্তব্য করে বসেন হিন্দুরা পৌত্তলিক। কিন্তু সঠিক দর্শন জানলে তাঁদের এ ভুল ধারণা ভাঙ্গবে না। আগেই বলেছি আমাদের দেবতা অনেক কিন্তু ঈশ্বর এক। ঈশ্বরের কোন প্রতিমা নেই। দেবতারা হলেন ঈশ্বরের এক একটি রূপের বা গুণের প্রকাশ। মূর্তি বা প্রতিমা হল সে সকল গুণের প্রতীক, চিহ্ন বা রূপকল্প।
সব ধর্মেই এমন রূপকল্প, চিহ্ন বা প্রতীক আছে যা তাঁদের কাছে পবিত্র। এভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় জগতের সবাই পৌত্তলিক। এ প্রসঙ্গে "স্বামী বিবেকানন্দের" একটি ঘটনার কথা বললে আপনারা বুঝতে পারবেন।

পরিব্রাজক স্বামী বিবেকানন্দ তখন আলোয়ারের মহারাজের অতিথি । আলোয়াররাজ কথাপ্রসঙ্গে স্বামীজিকে জানালেন যে মূর্তি পূজায় তিনি বিশ্বাস করেন না । স্বামীজি একথা শুনে মহারাজার একটি চিত্র আনতে বললেন এবং রাজার দেওয়ানকে বললেন ওই ছবির উপর থুথু ফেলতে । সমস্ত রাজসভা নিঃশব্দে এই দৃশ্য দেখতে লাগল ।

দেওয়ান স্বামীজির নির্দেশ পালনে অসমর্থ হলেন, তখন স্বামী জি বললেন , "এই ছবি তো একটি রং করা কাগজ মাত্র। এই ছবি তো আর রাজা নয়। তাহলে এর উপর থুথু ফেলতে অসুবিধা কোথায় ?" স্বামীজির বারংবার নির্দেশ সত্ত্বেও দেওয়ান যখন রাজার ছবিতে থুথু ফেলতে পারলেন না তখন স্বামীজি রাজাকে বুঝিয়ে বললেন, '' ফটোগ্রাফ তো একটি জড়বস্তু। একখণ্ড রং করা কাগজ মাত্র । তবু ওই ছবিটি আসল মানুষটিকে মনে করিয়ে দেয় । ছবিটির দিকে দেখলে আমরা ভাবি না যে নিছক কোনও রং করা কাগজ দেখছি । ঠিক তেমনই আমরা যখন মাটির মূর্তি পূজা করি আমরা মনে করি স্বয়ং ভগবানকেই পূজা করছি । আমরা সে সময় কখনও মনে করিনা আমরা কোনও জড় মূর্তি বা খড় বা মাটির উপাসনা করছি । আমরা দেবতার মূর্তিকে শুধুমাত্র প্রতীক মনে করি এর বেশি কিছু নয় । এজন্য পূজার সময় পূজারী ব্রাহ্মণগন মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন অর্থাৎ ধরে নেয়া হয় দেবতাগন ঐ প্রতিমায় ভাস্বর হয়ে উঠবেন। আবার কাঠমাটির প্রতিমা যে ঐ সকল দেবতা নয় তার প্রমান মেলে পূজার পর প্রতিমা গুলোকে জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। যদি প্রতিমাকেই ঐ সকল দেবতা মনে করা হত তাহলে নিশ্চয় কেউ তা জলে বিসর্জন দিত না। তাই হিন্দুর দেবমূর্তি পুতুল নয়। তা চিন্ময় ভগবানেরই মৃন্ময় রূপ।"
সনাতন ধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের উপাসনার বিধান আছে। যারা ঈশ্বরের অব্যক্ত বা নিরাকার উপাসনা করেন তাঁদের বলে নিরাকারবাদী। আর যারা ঈশ্বরের সাকার রূপের উপাসনা করেন তাঁরা সাকারবাদী।

এজন্য স্বামী বিবেকানন্দের বলেছেন, "পুতুল পূজা করে না হিন্দু/ কাঠ মাটি দিয়ে গড়া। মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে, হয়ে যাই আত্মহারা।"

এখন প্রশ্ন আসতে পারে আমরা কেন তাহলে নিরাকার ঈশ্বরের পূজা না করে সাকার ঈশ্বরের পূজা করি?
জাগতিক মোহ থেকে সাকার পূজা করা হয়ে থাকে। আগেই বলেছি যে বিদ্যা চায় সে সরস্বতী দেবীর প্রার্থনা করে, যে অর্থ চায় সে লক্ষ্মী দেবীর প্রার্থনা করে। তেমনি যে বিভিন্ন বাধা বিপত্তি থেকে উদ্ধার চায় সে দুর্গা পূজা করে। এজন্য গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন,“জড় বাসনার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে তাঁরাই অন্য দেবদেবীর পূজা করেন এবং স্বীয় স্বভাব অনুসারে নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করেন”----( শ্রীমদ্ভগবদগীতা, ৭ম অধ্যায়, শ্লোক ২০)। দেবতার রূপ ও গুণ মানুষের বিচিত্র রুচিকে তৃপ্ত করে ও চঞ্চল মনকে অচঞ্চল করতে সহায়তা করে।

আমাদের মন যে চঞ্চল তার উদাহরণ মন্দির বা উপাসনালয়ে গেলে মনে পবিত্রতা আসে, মন প্রাশান্ত হয়, মনে ভক্তি জেগে ওঠে। অথচ ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। তাহলে কেন শুধুমাত্র মন্দিরে গেলেই মন বেশি ভক্তিভাব আসে। আসলে জাগতিক মোহে আবদ্ধ হয়ে আমরা ঈশ্বরের এই সর্ববিরাজমানতা ভুলে যাই।আর যারা সবখানে ঈশ্বরের এই অস্তিত্ব অনুভব করতে পারেন তারাই নিরাকার উপাসনার যোগ্য। তেমনি একটি ছোট বাচ্চাকে কিংবা কোন অজ্ঞ ব্যক্তিকে নিরাকার ঈশ্বর সম্পর্কে ধারণা দিবেন সে বুঝবে না বরং সে সহজে বুঝবে সাকার দেবতারূপ ঈশ্বরকে। এই সাকার রূপের প্রতিমা দেখে সহজেই বুঝতে শিখবে ঈশ্বরের গুণের কথা, শক্তির স্বরূপ সম্পর্কে । এভাবে শুরুতে সাকার উপাসনার মধ্য দিয়েই নিরাকার উপাসনার যোগ্যতা অর্জন হয় আমাদের। তবে সব কিছুই যেহেতু সেই অসীমেরই অংশ তাই শ্রদ্ধা সহকারে দেবতার পূজাও পরোক্ষভাবে ঈশ্বরের উপাসনা।

👉এজন্য সনাতন সংস্কৃতিতে দেখা যায় শুধু মাত্র দেবতা নয় উদ্ভিদ, উপকারী প্রাণি এমনকি মনুষ্য পুজাও করে থাকেন অনেকে। তবে দেবোপাসনায় কাম্য বস্তু লাভ হলেও ঈশ্বর লাভ হয় না। শুধুমাত্র পরম ঈশ্বরের উপাসনাতেই ঈশ্বর লাভ হয়। এজন্য গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন,
‘যন্তি মদযাজীনহপি মাম ’ (শ্রীমদ্ভগবদগীতা, অধ্যায় ৯, শ্লোক ২৫) অর্থাৎ একমাত্র আমার ভক্তগণই আমাকে প্রাপ্ত হন। মূর্তি বা ভগবত বিগ্রহ প্রতীক বটে ।