👉বিভিন্ন ধর্মে স্ত্রীকে স্বামীর দাস হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, অপরদিকে সনাতনধর্মে স্বামীকে স্ত্রীর প্রভু নয়, বন্ধু বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।
✋মহাভারতের উদ্যোগ পর্বের ৩৪ অধ্যায়ের ৩৯ শ্লোকে বিদুর বলছেন,
পর্জ্জন্যনাথাঃ পণবো রাজানো মন্ত্রীবান্ধবাঃ।
পতয়ো বান্ধবাঃ স্ত্রীণাং ব্রাহ্মণা বেদবান্ধবাঃ ।।
অর্থ: মেঘ পশুগণের বন্ধু, মন্ত্রীরা রাজার বন্ধু, স্বামীরা স্ত্রীদের বন্ধু আর বেদ হচ্ছে ব্রাহ্মণে অর্থাৎ জ্ঞানীদের বন্ধু।
👉সনাতনধর্ম ও নারী পুরুষ সমতা:
সমাজে প্রচলিত তথাকথিত ধর্মগুলোতে নানা ভাবে নারীর প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে । এদের মধ্যে আব্রাহমিয় ধর্ম নারীদের সৃষ্টি কাহিনীর মাধ্যমে নারীদের প্রতি বৈষম্যের বীজ বপন করেছে। এসব ধর্মমতে সৃষ্টি কর্তা পুরুষকে সৃষ্টি করে , তার পাঁজরের হাড় থেকে নারীদের সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু নারীরা পুরুষ হতে সৃষ্ট তাই নারী হচ্ছে পুরুষের দাসী । নারীর স্বভাব হচ্ছে পাঁজরের হাড়ের মতো বাঁকা!
অপরদিকে সনাতনধর্মে বলা আছে নারী পুরুষ উভয়ই ঈশ্বরের সৃষ্টি , তারা সমান ও একে অপরের অর্ধাংশ স্বরূপ। এই কথাটির উল্লেখ আমরা দেখতে পাবো বেদের জ্ঞানকাণ্ড বৃহদারণ্যক উপনিষদের ১/৪/৩ এ । সেখানে উল্লেখ আছে-
"স বৈনৈব রেমে তষ্মাদেকাকীন রমতে স দ্বিতীয় মৈচ্ছৎ স হৈতাবানাস যথা স্ত্রীপুমাংসৌ সংপরিষক্তৌ স ইমমেবাত্মানং দ্বেধাপাতরত্ততঃ পতিশ্চ পত্মী চাভবতাং তস্মাদিদ মর্ধবৃগলমিব স্ব ইতি হ স্মাহ যাজ্ঞবল্ক্যস্তস্মাদয়মাকাশঃ স্ত্রিয়া পূর্যত এবং তাং সমভবত্ততো মনুষ্যা অজায়ন্ত। "
এর বাংলা অর্থ হচ্ছে, "ঈশ্বর (সৃষ্টির আদিতে) জনশূণ্য প্রকৃতি দেখে আনন্দ লাভ করলেন না। তাই এখনও কেউ একা থাকলে আনন্দ লাভ করে না বা একা থাকতে পারেন না। তিনি দ্বিতীয় (ঈশ্বর নিজ ভিন্ন) এক ব্যক্তিকে সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করলেন। তাঁর মধ্যে নারী ও পুরুষের সকল শক্তি অবস্থিত ছিলো । তখন তিনি স্ত্রী ও পুরুষ সৃষ্টি করার জন্য স্বীয় শক্তিকে দ্বিভাগ করে পুরুষ ও স্ত্রী শক্তি সৃষ্টি করলেন। এরূপে তাঁরা (নব্য সৃষ্ট পুরুষ ও স্ত্রী) স্বামী ও স্ত্রী হলেন। এজন্য যাজ্ঞবল্ক্য বলেন, প্রত্যেকে নিজে অর্ধ বিদলের ন্যায়। এইজন্য এই বাকী অর্ধ শুণ্য স্থান নারী দ্বারা পূর্ণ হয়। সেই নব্য সৃষ্ট পুরুষ স্ত্রীতে মিথুনভাবে উপগত হয়েছিলেন। এতে করে পরবর্তীতে (আরও) মানব উৎপন্ন হয়েছিলো। "
মনুসংহিতাতেও একই কথা বলা আছে,
সেই প্রভু প্রজাপতি আপনা শক্তিকে দ্বীখন্ডিত করে অর্ধেক অংশে পুরুষ ও অর্ধেক অংশে নারী সৃষ্টি করলেন। (মনুসংহিতা ১/৩২)
সনাতনধর্ম ও নারীর শুদ্ধতা ও পবিত্রতা
সনাতনধর্ম সর্বোৎকৃষ্ট মানবতাবাদী ধর্ম।আর সনাতন ধর্মশাস্ত্র বিশেষ করে বেদে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা দান করা হয়েছে। বেদে নারীদের সর্বদা শুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে।।
शुद्धाः पुता योषितो यज्ञिया इमा आपश्चरुमब सर्पन्तु शुभ्राः । अदुः प्रजां बहुलान्पशुन्नः पक्तौदनस्य सुकृतामेतु लोकम् ।।
অথর্ব বেদ ১১/১/১৭
অর্থ: শুদ্ধ,পবিত্র ও পূজনীয় রমণীগণ ও তাঁদের পবিত্র কর্ম জলের ধারার মতো পবিত্র পাত্রে প্রবেশ করুক ও যজ্ঞের জন্য পবিত্র ভোগ্যবস্তু তৈরি হোক।তাহারা আমাদের উত্তম বংশধর ও প্রভূত ধনসম্পদ দান করুন।যারা অমৃতসত্তার জন্য উৎকৃষ্ট খাদ্য তৈরি করে,তারা যেন জীবনের সর্বোচ্চ অর্জনের শিখরে পৌঁছান।(তুলসী শর্মা)
👉সনাতনধর্ম ও স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক:
সনাতনধর্মে স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার বন্ধনকে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়। এই ধর্ম সর্বদা স্বামী স্ত্রীকে একত্রে থাকার কথা বলে , কারণ স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকলে তাদের ধর্মকর্মাদি সব বিফল হয়। এজন্যই বোধহয় স্ত্রীকে সহধর্মিণী বলে ।
ন বৈ তেষাং স্বদতে পথ্যমুক্তং যোগক্ষেমং কল্পতে নৈব তেষাম।
ভিন্নানাং বৈ মনুজেন্দ্র! পরায়ণং ন বিদ্যতে কিঞ্চিদন্যদ্বিনাশাৎ।।
-মহাভারত উদ্যোগ ৩৬/৫৭
অর্থ- নরশ্রেষ্ঠ! স্বামী ও স্ত্রী পৃথক স্থানে থাকলে, তাদের কাছে কোনো খাবারই সুস্বাদু বলে বোধ হয়না এবং শাস্ত্রোক্ত যোগক্ষেম সম্ভব হয়না। সেইরূপ জ্ঞাতিরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকলে, তাদের ভিন্ন অন্য কোনো গতি থাকেনা।
সনাতনধর্ম ও নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টি:
..........................................
বিভিন্ন ধর্মে নারীকে গৃহ বন্দী, পর্দায় ঘিরে রাখা হয় তাদের পুরুষের হাত থেকে রক্ষার জন্য। সমাজে পুরুষরা সর্বদা নারীদের প্রতি অন্যায় অত্যাচার করলেও সেই সমস্ত ধর্ম পুরুষদের সংযত হওয়ার উপদেশ না দিয়ে উল্টো নারীদের পর্দার অন্তরালে দাবিয়ে রাখে। আবার পুরুষদের বহুবিবাহের অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে তাদের লাম্পট্যকে আস্কারা দিচ্ছে।
অপরদিকে সনাতনধর্ম পুরুষদের প্রতি উপদেশ দেয় তাদের নজর অবনত রাখার, নারীদের মাতৃজ্ঞান করার। নারীদেরকে পুরুষের কারণে ঘরে বন্দী করে রাখার বদলে পুরুষদের দৃষ্টি, মন, মানসিকতা শুদ্ধ ও সংযত রাখতে বলে সনাতনধর্ম।
বেদে নারী ও পুরুষের পোশাক সর্ম্পকে বলা হয়েছে,
"অধঃ পশ্যস্ব মোপরি সন্তরাং পদকৌ হর । মা তে কশপ্লকৌ দষান্তস্রীহি ব্রক্ষা ভুবথি”।। [ঋগ্বেদ ৮.৩৩.১৯]
র্অথঃ হে পুরুষ ও নারী তোমাদের দৃষ্টি সবসময় হোক ভদ্র ও অবনত । তোমাদের চলন হোক সংযত, দেহ হোক পোষাকে আবৃত , নগ্নতা হোক পরিত্যাজ্য।
মাতৃবৎ পরদারেষু পরদ্রব্যেষু লোষ্টবৎ।
আত্মবৎ সর্বভূতেষু য পশ্যতি সঃ পণ্ডিতঃ।।
- চাণক্যনীতি
অর্থ- যে ব্যক্তি অন্যের স্ত্রীকে মাতৃরূপ দেখেন, অন্যের দ্রব্যকে মাটির ঢেলার মতো জ্ঞান করেন এবং সকল জীবে আত্মজ্ঞান অনুভব করেন, তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি।
সনাতনধর্ম ও স্ত্রীর উপর বলপ্রয়োগ:
বিভিন্ন ধর্ম স্ত্রীকে প্রহার করার অধিকার দেয়। কিন্তু সনাতনধর্ম স্ত্রীকে প্রহার করা তো দূরে থাক, স্ত্রীর উপর বলপ্রয়োগ করা নিষেধ করেছে,
ব্রহ্মণেষু চ যে শূরাঃ স্ত্রীষু জ্ঞাতিষু গোষু চ।
বৃন্তাদিব ফলং পক্বং ধৃতরাষ্ট্র! পতন্তি তে।।
- মহাভারত উদ্যোগ পর্ব ছত্রিশ অধ্যায় একষট্টি শ্লোক।
অর্থ- হে ধৃতরাষ্ট্র! ব্রাহ্মণ অর্থাৎ জ্ঞানী, স্ত্রী, জ্ঞাতি ও গোজাতি অর্থাৎ নিরীহ গৃহপালিতর উপর যারা বলপ্রয়োগ করে তারা পতিত হয়।
👉সনাতনধর্ম ও স্ত্রী লোক অবধ্য:
অন্যসব নিচ ধর্ম তাদের স্বার্থের জন্য নারীদের পাথর ছুঁড়ে হত্যার মতো ঘৃণ্য নিয়ম সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে সনাতনধর্ম মতে নারীদের অবধ্য বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ।
অবধ্য ব্রাহ্মণা গাবো জ্ঞাতয়ঃ শিশবঃ স্ত্রিয়।
যেষাং চান্নাতি ভুঞ্জীত যে স্যুঃ সরণাগতাঃ।।
-মহাভারত উদ্যোগ ছত্রিশ অধ্যায় ছেষট্টি শ্লোক।
অর্থ- যাদের অন্ন ভোজন করা হয় এবং যারা শরণাগত হয় তারা, ব্রহ্মণ অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানী, গরু, জ্ঞাতি, শিশু ও স্ত্রীলোক, এরা সকলেই অবধ্য।

