Ticker

200/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

Responsive Advertisement

হরে কৃষ্ণ হরে রাম মন্ত্র কি অবৈদিক?

 


হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

ইতি ষোড়শকং নাম্না কলিকল্মষনাশকম্।
নাতঃ পরতোপায়ঃ সর্ববেদেষু দৃশ্যতে।।" (কলিসন্তরণ উপনিষদ ১-২)

আমাদের সমাজে অনেকেরাই এই "হরে কৃষ্ণ হরে রাম" ষোড়শাক্ষর মন্ত্রটিকে অবৈদিক মনে করেন।কিন্তু এই মন্ত্রটি কি আদৌও অবৈদিক? বেদশাস্ত্র কি বলে? উত্তর- মোটেও অবৈদিক নয়।এই মন্ত্রের হরে(হরি), রাম, কৃষ্ণ এই শব্দত্রয় বেদোক্ত পরব্রহ্মেরই অজস্র নামের মধ্যে মহিমান্বিত নাম।কারণ এক পরব্রহ্ম ভগবান নারায়ণকেই বিদ্বানগণ বহুনামে ডাকেন।"সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি" (ঋগ্বেদ-১/৬৪/৪৬)। বেদের সংহিতা, উপনিষদ, আরণ্যক এই নামত্রয়সমূহ পরব্রহ্মবাচক হিসেবে পাওয়া যায় অর্থাৎ এই নামসমূহ বেদোক্ত ভগবানেরই নাম। আর এই নামত্রয় কলিসন্তরণ উপনিষদে ষোড়শাক্ষরে ছন্দবদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ। এই নামত্রয় কীর্তন বা জপও কোনো অবৈদিক নয়।কারণ বেদেই বলা হয়েছে যে ভগবান বিষ্ণুর কীর্তন তার মহিমাকে গাওয়ার জন্য।

"তমু স্তোতরঃ পূর্ব্যং যথা বিদ ঋতস্য গর্ভং জনুষাপিপর্তন।
আস্য জানন্তো নাম চিদ্বিবক্তন মহন্তে বিষ্ণু সুমতিং ভজামহে।।" (ঋগ্বেদ ১/১৫৬/৩)

অনুবাদ: হে স্তোতৃগণ, যিনি যজ্ঞের গর্ভরূপ, চিরপুরাতন সেই বিষ্ণুদেব সম্যস্থিত যে জ্ঞান দ্বারা পরিচিত, সেই অনুসারে স্তোত্রাদিদ্বারা তার প্রীতি সাধন করুন। উনার তেজস্বী পরাক্রম থেকে সম্যস্থিত জ্ঞানকারীর অনুরূপ আপনারা উনার বর্ণনা ও কীর্তন করুন। হে সর্বব্যাপক ভগবান বিষ্ণু! আপনি মহানুভব,আমরা আপনার শ্রেষ্ঠ সুমতি ভজনা করি।
অর্থাৎ শ্রুতিবাক্য দ্বারা সিদ্ধ হয় যে ভগবান বিষ্ণুর নাম কীর্তন করা অবৈদিক নয়।ঠিক একই কথা ভগবান কৃষ্ণও গীতাতে অর্জুনের নিকট উপদেশ করেন।

"সততং কীর্তয়ন্তো মাং যতন্তশ্চ দৃঢ়ব্রতাঃ।
নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা নিত্যযুক্তা উপাসতে।।" (৯/১৪)

অনুবাদ:তাঁহারা (সাত্ত্বিকী প্রকৃতি-প্রাপ্ত মহাত্মগণ) যত্নশীল ও দৃঢ়ব্রত হইয়া ভক্তিপূর্বক সর্বদা আমার কীর্তন করেন ও ভক্তিপূর্বক আমার উপাসনা করেন।

অতএব ভগবান বিষ্ণুর নাম কীর্তন করা বৈদিক শাস্ত্র সম্মত।এখন প্রশ্ন আসে যে এই কলিসন্তরণ উপনিষদের "হরে কৃষ্ণ রাম" শব্দত্রয় বেদশাস্ত্রে কোথায় ঈশ্বরের পরব্রহ্মবাচক নাম? হরে(হরি), রাম, কৃষ্ণ শব্দত্রয়ের বুৎপত্তি বেদেই। প্রথমে আমরা "হরে" শব্দের উৎপত্তি ও বৈদিক নিঘন্টু কোষ, ব্যাকরণগত, শাস্ত্র ও আচার্য ভাষ্য সহিত জানার চেষ্টা করি।
"হরে" সংস্কৃত ব্যাকরণ হরে শব্দটি মূলত "হৃ" ধাতু থেকে উৎপত্তি। যার অর্থ হরণ করা। √হৃ (হরণ করা) + এ(৬ষ্ঠী বিভক্তি যুক্ত হয়ে হরে।

👉"হরে" শব্দটিকে ভগবান বিষ্ণুর অপর নাম "হরি" সম্বোধনসূচক পদ হিসাবে ব্যক্ত করে। √হৃ (হরণ করা) +ই (ইন্) =হরি। হরি শব্দে "হৃ" ধাতুর সহিত প্রথমা বিভক্তি যুক্ত হয়ে "হরি" শব্দ গঠিত হয়।অর্থাৎ হরে শব্দ ভগবান বিষ্ণুর হরি শব্দেরই সম্বোধনসূচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।নিম্নে হরি শব্দে বিভিন্ন বিভক্তি ও সম্বোধনসূচক পদগুলো তুলে ধরা হলো-
বিভক্তি একবচন দ্বিবচন বহুবচন
প্রথমা হরিঃ হরী হরয়ঃ
দ্বিতীয়া হরিং হরী হরীৎ
তৃতীয়া হরিণা হরিভ্যাম্ হরিভিঃ
চতুর্থী হরয়ে হরিভ্যাম্ হরিভ্যঃ
পঞ্চমী হরেঃ হরিভ্যাম্ হরিভ্যঃ
ষষ্ঠী হরেঃ হর্য়োঃ হরীণাং
সপ্তমী হরৌ হর্য়ো হরিষু
সম্বোধন হে হরে! হে হরী! হে হরয়ঃ!
আশা করি হরে শব্দ যে মূল হরি শব্দেরই সম্বোধনবাচক শব্দ এই বিষয়টা পরিষ্কার হলো।এবার আমরা দেখে নিবো বেদশাস্ত্রের কোথায় হরি শব্দের উল্লেখ রয়েছে-প্রথমেই কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের "নারায়ণসুক্তে" ভগবান নারায়ণকে হরি শব্দে অভিহিত করা হয়েছে।

"বিশ্বতঃ পরমান্নিত্যং বিশ্বং নারায়ণং হরিম্।" (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১০/১৩/২)-বিশ্বসমূহে যিনি হলেন পরমনিত্য এবং এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সকলই সেই নারায়ণ হরিময়।"স ব্রহ্ম স শিবঃ স হরিঃ স ইন্দ্রঃ সোঽক্ষরঃ পরমঃ স্বরাট্॥"(তৈ০ আ০ ১০/১৩/১২)- সেই নারায়ণই ব্রহ্মা, তিনিই শিব, তিনিই হরি, তিনিই ইন্দ্র যিনি অবিনাশী, পরম(চূড়ান্ত গতি বা লক্ষ্য), যিনি সমস্ত কর্মের নিয়ন্ত্রণকর্তা। অর্থাৎ, ভগবান নারায়ণের অপর নাম হলো হরি।এখন বৈদিক নিঘন্টু কোষে "হরি" শব্দে কি অর্থ করেছে যাস্কাচার্য দেখা যাক-হরি হচ্ছে ভগবানের অনন্ত নামের মধ্যে শক্তিসম্পন্ন নাম।যেমন, "যুক্তাহ্মস্য হরয়ঃ শতাদশ" (ঋ০ বে০ ৬/৪৭/১৮)-বর্ণিত হয়েছে যে "হরয়ঃ"= অনন্ত শক্তিসম্পন্ন হওয়ার কারণ স্বরূপ ঐ পরমাত্মা শক্তিমান। "হরি" শব্দ শক্তির এই প্রকার অর্থ যে "হরতি ইতি হরিঃ" যিনি প্রতিদন্ধী শক্তিকে হরণ করেন।যিনি অবিদ্যা, ক্লেশাদিকে হরণ করেন তাহার নামই হরি। এই অভিপ্রায়ে বেদে হরি শব্দে হরণ করাকেই বুঝিয়েছে।যেমন-সূর্যের কিরণের নাম হরি।কেনো না তা অন্ধকারকে হরণ করেন।নিরুক্তে(২/২৮) বলা হয়েছে- "হরি ইন্দ্রস্য, রোহিতোহ্গ্নেঃ"- ইন্দ্র(ঈশ্বরের) শক্তি তথা অগ্নির জ্বলার(প্রভা) নাম হরি।কেনো না অগ্নির প্রভা অন্ধকারকে হরণ করেন।তাই হরি শব্দে ঈশ্বরের শক্তি দ্বারা হরণকেই নির্দেশ করে।ভগবদ্পাদ আদি শঙ্করাচার্য মহাভারতের "বিষ্ণুসহস্রনাম" এ ভগবান বিষ্ণুর ৬৫৬ নং নাম "হরি" শব্দের ভাষ্য করেন- "মহেতুকং সংসারং হরতীনি হরিঃ" অবিদ্যারূপ কারণ সহিত সংসারসমূকে হরণ করেন বিধায় তিনি হরি।অর্থাৎ জগতের অবিদ্যাকে যিনি হরণ করেন। ভগবান কৃষ্ণ মহাভারতের "হরি" শব্দের ব্যাখ্যা করেন।সেখানে তিনি বলেন যে, তিনি যজ্ঞের ভাগ হরণ করেন বিধায় তিনি হরি অর্থাৎ তিনি যজ্ঞের ভোক্তা এবং হরিন্মণির ন্যায় উজ্জ্বল অর্থাৎ হরিৎ বর্ণ তাই তাহার নাম হরি।


"ইলোপহূতে যোগেন্ হরে ভাগং ক্রতুম্বহম্।
বর্ণশ্চ মে হরিশ্রেষ্ঠস্তস্মাদ্ধরিরহং স্মৃতঃ।।" (মহাভারত, শান্তিপর্ব,৩২৮/২৫৪)

অনুবাদ: যজ্ঞে বাক্যদ্বারা আমার আহ্বান করা হয়, তখন আমি যজ্ঞের ভাগ হরণ করি; অথবা আমার দেহের বর্ণ হরিন্মণির ন্যায় উৎকৃষ্ট; এই জন্য আমি হরি বলিয়া কথিত হই।

নিরুক্ত অভিধানেও হরি শব্দে হরিৎ বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমনটা ভগবান কৃষ্ণ মহাভারতে উল্লেখ করেন।"হরি সোমো হরিতবর্ণঃ" (নিরুক্ত ৪/৩)-হরি=সোম, হরেবর্ণ (হরিৎবর্ণ)।শ্রীপরাশর ভট্ট স্বামী বিষ্ণুসহস্রনামের "হরি" নামের ভাষ্যে বলেন-"গিরি গোবর্ধনাখ্যে তু দেবঃ সর্বেশ্বর হরিঃ।সংস্থিত পূজিতঃ স্থানে" ইতি হরিঃ।।ইডোপহুতং গেহেষু হরেঃ ভাগং ঋতুষ্বহম্ বর্ণশ্চ মে হরিশ্রেষ্ঠ তস্মাদ্ হরিঃ ইতি স্মৃতঃ।।"-"ব্রহ্মাণ্ডের মহান প্রভু, হরি নামে গোবর্ধন পাহাড়ে আরাধনাস্থলে বাস করেন।যজ্ঞে আমন্ত্রিত হয়ে, আমি আমার কাছে প্রদত্ত নৈবেদ্য গ্রহণ করি এবং তাই আমাকে 'হরি' বলা হয়।আমার সেই হরিশ্রেষ্ঠ বর্ণ তাই আমাকে হরি বলা হয়।
কারণ ভগবান বিষ্ণু গিরি গোবর্ধনরূপে গোকুলবাসীকে রক্ষা করেন এবং ইন্দ্রের অহংকারকে হরণ করেন। গোকুলবাসীকর্তৃক যজ্ঞভাগও (নৈবেদ্য) হরণ করেন এবং হরিৎ বর্ণ বলে তিনি হরি নামে খ্যাত।মধ্ব পরম্পরায় শ্রীবিদ্যাত্মতীর্থ "কৃষ্ণামৃতমহার্ণব" গ্রন্থের প্রারম্ভে তিনি ভগবানের বিভিন্ন নামের ব্যাখ্যায় "হরি" নামের ব্যাখ্যা বলেন যে- সকল পাপসমূহ এবং জন্মমৃত্যু-জরাব্যাধিকে(অর্থাৎ মোক্ষ প্রাপ্তি) হরণ করেন তিনিই হরি।ভগবান কৃষ্ণ গীতায় অর্জুনকে বলেন যে, সকল কিছু পরিত্যাগ করেন ভগবানের শরণে আসতে যিনি সকল পাপসমূহ হরণ করবেন-

"সর্বধর্মান্পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ৷
অহং ত্বা সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ৷৷" (গীতা ১৮/৬৬)

অনুবাদ: সমস্ত ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শ্বরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। সে বিষয়ে তুমি কোন দুশ্চিন্তা করো না।
এবং ভগবৎ শরণাগত হয়ে তাকে লাভ করলে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না।তখন জীব মোক্ষ অর্থাৎ বিষ্ণুর পরমপদকে প্রাপ্ত হয়।"মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে৷৷"(গীতা ৮/১৬) অনুবাদ: হে কৌন্তেয়, আমাকে লাভ করলে তার আর জন্ম হয় না।
অতএব,"হরে" শব্দ মূলত শ্রীহরি।মূখ্যভাবে যিনি ভক্তের সকল তমঃ আদি অবিদ্যা, ক্লেশ,পাপসমূহ হরণ করেন সেই পরব্রহ্ম ভগবানকেই হরি বলা হয়। কারণ শ্রুতিতেই উল্লেখ তিনি আমাদের অসত্য থেকে সত্য পরিচালিত করেন, অবিদ্যারূপ অন্ধকারকে হরণ করে জ্যোতি অর্থাৎ আলোকে চালিত করেন এবং মৃত্যু থেকে অমৃত অর্থাৎ মোক্ষ প্রদান করেন।"অসতো মা সদ্গময়। তমসো মা জ্যোতির্গময়। মৃত্যোর্মামৃতং গময়।।" (বৃহদ্বারণ্যক উপনিষদ ১/৩/২৮)


👉"রামসংস্কৃত ব্যাকরণের "রাম" শব্দটি মূলত "রম্" ধাতু থেকে উৎপত্তি। যার অর্থ নিমগ্ন হওয়া/প্রসন্ন বোধ করা।"√রম্ (আসক্তি) +অ (ঘঞ্)=রাম। "রম্" ধাতুতে "ঘঞ্" প্রত্যয় যুক্ত হয়ে "রাম" শব্দ নিষ্পন্ন হয়।নিরুক্তে(১২/১৩) বলা হয়েছে- "রামা রমণায়োপেয়তে ন ধর্মায়" অর্থাৎ শুদ্র স্ত্রী উপগতা হয় রমণের নিমিত্তে, ধর্মের জন্য নয়। অর্থাৎ এখানে রামা স্ত্রী লিঙ্গ বিশেষ। যার পুরুষ লিঙ্গ হলো রাম।যার অর্থ রমণীয়।এখানে রামা শব্দে ভাষ্যকারগণ শুদ্র স্ত্রী উল্লেখ করেছন।কারণ তারা যদিও সুন্দর, রমণীয় কিন্তু ধর্মের নিমিত্তে তারা রমণে উপগতা হয় না।তাই রামা শব্দের শুদ্র স্ত্রী উল্লেখ করেছেন। এখানে স্পষ্ট যে রামা রমণে উপগত হয়।অর্থাৎ রম্ ধাতু রমণ(বিহার/নিবাস)অর্থেই ব্যবহৃত হয়।তাছাড়া ছান্দোগ্য উপনিষদেও(৮/১২/৩) এই "রম্" ধাতুকে ক্রীড়ারূপেই উল্লেখ করা হয়েছে - "ক্রীড়ণ রমমানঃ। যিনি প্রাণীসমূহের হৃদয়ে বিহার বা নিবাস করেন তিনিই রাম।ভগবদ্পাদ মধ্বাচার্য্য তার গীতাভাষ্যে("রামঃ শস্ত্রভৃতামহম্"-অস্ত্রধারীদের মধ্যে আমি রাম-১০/৩১ নং শ্লোকে)"রাম" শব্দের ব্যাখ্যা করেন যে- "আনন্দরূপত্বাৎ পূর্ণত্বাৎ লোকরমণাশ্চ রামঃ।আনন্দরূপো নিষ্পরীমাণ এষ লোকশ্চৈতস্মাদ্রমতে তেন রামঃ ইতি শাণ্ডিল্যশাখায়াম্।।" -আনন্দস্বরূপ হওয়ার কারণে, পূর্ণ হওয়ার কারণে, লোকসমূহকে প্রসন্ন বিধান হওয়ার কারণে তাকে রাম রূপে জ্ঞাত হয়।আনন্দময় রূপের, সীমাহীন, যাঁর নিকট থেকে জগৎ উদ্ভাসিত হয়, তিনি হলেন রাম", এইভাবে শাণ্ডিল্যখণ্ডে বর্ণিত। তাই "রাম" শব্দটি পরমাত্মাবাচক শব্দ। বেদে সংহিতায় পরব্রহ্মকে রাম নামে অভিহিত করা হয়েছে অর্থাৎ যার মধ্যে জীবসকল নিমগ্ন হোন।
"প্র তদ্দুঃশীমে পৃথবানে বেনে প্র রামে বোচমসুরে মঘবৎসু ।
যে যুক্ত্বায় পঞ্চ শতাস্ময়ু পথা বিশ্রাব্যেষাম্ ॥" (ঋগ্বেদ ১০/৯৩/১৪)

পদার্থ:(যে অস্ময়ু) আমাদের যেসকল মঙ্গলকামী ব্যক্তি (প্র তদ্) সেই (পঞ্চশতা) পাঁচ প্রকার প্রবল অনন্ত মনোবৃত্তিকে নিবেশ করে (পথা) মার্গ দ্বারা চলার সময় (দুঃশীমে) দুঃখাদি বাসনাকে নষ্টকারী (পৃথবানে) সর্বত্র বিস্তৃত মহিমাকারী (বেনে) পরমজ্ঞানী (অসু-রে) সমস্ত কিছুতে প্রাণ দানকারী প্রভু (রামে) শ্রীরামে (যুক্ত্বায়) যুক্ত থাকে (মধবৎসু) এরকম জ্ঞানধন সম্পন্ন মনুষ্যের মাঝে (বিশ্রাবি এষাম্) পরমাত্মজ্ঞান এর অর্থ বিশেষরূপে (প্রবোচম্) উপদেশ করা উচিত।
ভাবার্থ: আমাদের যেসকল মঙ্গলকামী বিদ্বানগণ সেই পাঁচ প্রকার অনন্ত প্রবল মনোবৃত্তিকে নিবেশ করে মার্গ(কর্ম/জ্ঞান/ভক্তি) দ্বারা চলার সময় দুঃখাদি বাসনাকে নষ্টকারী, সর্বত্র বিস্তৃত মহিমাকারী, যিনি সকল জ্ঞানের উৎস, সমস্ত কিছুতে প্রাণ দানকারী প্রভু শ্রীরামে যুক্ত একনিষ্ঠ থাকেন এরকম জ্ঞানধন সম্পন্ন মনুষ্যের মাঝে পরমাত্মজ্ঞান এর অর্থ বিশেষরূপে উপদেশ করা উচিত।
অর্থাৎ, এখানে ভগবানের ভক্তের গুণের সম্পর্কে বলা হয়েছে। ভগবদ্ভক্ত সর্বদা জীবের দুঃখকে নিজের দুঃখ বলে স্বীকার করেন এবং জীবের সুখকে নিজের সুখ বলে স্বীকার করেন।তাহার নিজের সুখ-দুঃখ বলে কিছু নেই।
"আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জুন৷
সুখং বা যদি বা দুঃখং সঃ যোগী পরমো মতঃ৷৷"(গীতা ৬/৩২)
অনুবাদ: হে অর্জুন! যিনি সমস্থ জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখ বলে মনে করেন আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।
তাই ভগবদ্ভক্ত মহাত্মাগণ সর্বদাই জীবের মঙ্গলকামনা করেন।কারণ জীবের মঙ্গলই তাহার মঙ্গল।তাই মহাত্মাগণ বেদোক্ত শান্তিমন্ত্র পাঠ বা ভগবৎ-প্রার্থনার মাধ্যমে সর্বজীবের মঙ্গলকামনা করেন।"সর্বেষাং মঙ্গলং ভূয়াৎ । সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ । সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু । মা কশ্চিদ্ দুঃখভাগ্ ভবেৎ।।" (গরুড়পুরাণ,উত্তর,৩৫/৫১)-সকলের মঙ্গল হোক । সবাই হোক রোগদুঃখহীন । সকলেই কল্যাণের রূপ দেখুক । কেউ যেন দুঃখী না হয়।
এইসব মহাত্মাগণ তাদের ৫প্রকার ইন্দ্রিয়সকলের অনন্ত মনোবৃত্তিকে (পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়/পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়) এইসব কিছু নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিবৃত্তি করে ভগবানের চরণে অর্পণ করেন অর্থাৎ তার শরণাপন্ন হোন।

"প্রশান্তমনসং হ্যেনং যোগিনং সুখমুত্তমম্৷
উপৈতি শান্তরজসং ব্রহ্মভূতমকল্মষম্৷৷" (গীতা৬/২৭)

অনুবাদ: ব্রহ্মভূত অবস্থায় প্রশান্ত চিত্ত, রজবৃত্তি রহিত এবং নিষ্পাপ হয়ে যার মন আমাতে নিবিষ্ট হয়েছে তিনিই পরম সুখ প্রাপ্ত হন।
তখন মহাত্মাগণ ভগবদ্প্রদত্ত বিভিন্ন মার্গ(কর্ম,জ্ঞান, ভক্তি) দ্বারা ভগবানের নিজ জীবনকে পরিচালনা করেন।বৈষ্ণবাচার্যগণ সর্বদাই ভক্তিমার্গকেই শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছেন।এই মার্গদ্বারা অচিরে পরব্রহ্মকে লাভ করা যায়।

"ভক্ত্যা মামভিজানাতি যাবান্যশ্চাস্মি তত্ত্বতঃ৷
ততো মাং তত্ত্বতো জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্৷৷"(গীতা১৮/৫৫)

অনুবাদ: ভক্তির দ্বারাই কেবল পরমেশ্বর ভগবানকে পাওয়া যায়। এই প্রকার ভক্তি দ্বারা ভগবানকে যথাযথ ভাবে জানার ফলে ভগবদ্ ধামে প্রবেশ করা যায়।
এই মার্গ অনুযায়ী জীবন পর্যবাসিত করার সময় যেসব দুঃখকষ্ট আসে তখন ভগবান তাহা নাশ করেন(হরি)। এবং ভগবানের ষড়গুণ্যের মধ্যে একটি হলো যিনি সমস্ত জ্ঞানের উৎস।তাই তিনি পরমজ্ঞানী।সেই পরমপ্রভুর মধ্যেই জ্ঞান সম্পূর্ণরূপে বিদ্যমান।তাই তিনি ভগবান।

"ঐশ্বর্য্যস্য সমগ্রস্য ধর্মস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ ।
জ্ঞানবৈরাগ্যয়োশ্চৈব ষন্নত্ ভগ ইতিঙ্গনা॥" (বিষ্ণুপুরাণ ৬/৫/৭৪)

অনুবাদ:সম্পূর্ণরূপে ঐশ্বর্য, ধর্ম,যশ,শ্রী,জ্ঞান,বৈরাগ্য এই ছয় গুণকে ভগ বলে।
এই প্রভু সমস্ত কিছুতে সৃষ্টিপরে প্রাণদান করে তাহাতে নিবাস করেন।সেই প্রভু যিনি সর্বত্র রমণকারী প্রভু(নিবাসকারী) অর্থাৎ ভগবান শ্রীরাম তাহাতে সম্বন্ধ স্থাপন করেন,কারণ যাহারা ভগবানের সাথে নিত্যযুক্ত থাকেন তারাই ভগবানের একমাত্র প্রিয় এবং ভগবানও তাদের প্রিয়, তখনই জীব পরব্রহ্মে রমণ করে আনন্দ অনুভব করেন।

"তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত কভক্তির্বিশিষ্যতে৷
প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোত্যর্থমহং স চ মম প্রিয়ঃ৷৷" (গীতা৭/১৭)

অনুবাদ: এই চার প্রকার (আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানী)
ভক্তের মধ্যে আমাতে নিত্যযুক্ত একনিষ্ঠ তত্ত্বজ্ঞানীই শ্রেষ্ঠ। কেননা আমি তার অত্যন্ত প্রিয় এবং তিনিও আমার অত্যন্ত প্রিয়।
এই রকম জ্ঞানধন সম্পন্ন বিদ্বান মহাত্মাগণের নিকটই পরমাত্মতত্ব ভগবদ্জ্ঞান বিশেষরূপে প্রদান করা উচিত। কারণ যাহার হৃদয় প্রশান্ত নয় তাহাকে পরমাত্মজ্ঞান দান করা উচিত নয়।

"বেদান্তে পরমং গুহ্যং পুরাকল্পে প্রচোদিতম্।
নাপ্রশান্তায় দাতব্যং নাপুত্রায়াশিষ্যায় বা পুনঃ॥"(শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৬/২২)

অনুবাদ:এই পরমতত্ত্ব গুহ্যজ্ঞান পুরাকল্পেপ্রাক্কল্পে বেদের অস্তিমভাগে উপনিষদে উত্তমরূপে বর্ণিত হয়েছে যাঁর অন্তঃকরণ সর্বতােভাবে শান্ত হয়নি এরূপ মানবকে এই উপদেশ দেওয়া উচিত নয় তথা যে নিজ পুত্র নয় অথবা যে নিজ শিষ্য নয় তাকে দেওয়া উচিত নয়।কারণ শ্রদ্ধাবানসম্পন্ন জ্ঞানধন যাহাদের রয়েছে তাদেরকেই এই জ্ঞান বিশেষরূপে বর্ণনা করা উচিত। তারাই পরব্রহ্মতত্ত্ব জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম।

"শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তত্পরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ৷
জ্ঞানং লব্ধ্বা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি৷৷" (গীতা ৪/৩৯)

অনুবাদ: সংযতেন্দ্রিয় ও তৎপর হয়ে চিন্ময় তত্ত্বজ্ঞানে শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি এইজ্ঞান লাভ করেন, সেই দিব্যজ্ঞান লাভ করে তিনি অচিরেই পরম শান্তি লাভ হন।
পরব্রহ্ম ভগবান নারায়ণ নিজ আত্মাতে রমণ করে বিধায় তিনি আত্মারাম তথাপিও তিনি মাতা লক্ষ্মীর সহিত রমণ করেন। তিনি সর্ব অভিরাম অর্থাৎ সৌন্দর্য ও আনন্দদায়ক হয়েও তিনি নিজ আত্মায় রমন করেন এবং তিনি মরতকশ্যাম মণির ন্যায় বর্ণ বিধায় তিনি রাম নামে অভিহিত। সে সম্পর্কে শ্রীনারায়ণ পণ্ডিতাচার্য তার "সংগ্রহরামায়ণ" গ্রন্থে উল্লেখ করেন-

"একো নারায়ণোহগ্রেহভূত্ পূর্ণ্ণাগণ্যগুণার্ণ্ণবঃ।
আত্মারামোহপি রময়া রমমাণোহভিরাময়া।।
রাম সর্বাভিরাত্বাদাত্মারামত্বতোহপি বা।
দেবো মরতকশ্যাম ইতি বা রাম নামকঃ।।" (সংগ্রহরামায়ণ বালকাণ্ড-১/৮, ৩/৪৩)

অনুবাদ: জগৎসৃষ্টির পূর্বে একমাত্র নারায়ণই বিদ্যমান ছিলেন, তিনি পূর্ণগুণময় এবং গুণসমুদয়ের সমুদ্র, তিনি আত্মরাম হয়েও নিজস্বরূপ মনোহরা মাতা রমার সহিত তিনি রমণ করেন। ভগবান রাম সর্ব অভিরাম হয়েও তিনি আত্মারাম অথবা ভগবান মরতকমণির ন্যায় শ্যামবর্ণ বিধায় তিনি রাম নামে বিখ্যাত।
অর্থাৎ ভগবান নিজ আত্মায় তৃপ্ত হয়েও তাহার মহিমা কীর্তি বিস্তারের জন্য তিনি রমণ করেন। তিনি সর্বজীবে নিবাস করেন জীব যখন তাহাতে সম্বন্ধস্থাপন করেন তখনই পরব্রহ্মের আনন্দকে অনুভব করেন। ভগবান সর্বদাই জীবের হৃদয়ে রমণ করার ইচ্ছায় বিরাজ করেন কিন্তু জীব মোহমায়ায় আবদ্ধ থাকে বিধায় তাহাতে রমণ করতে পারে না।কিন্তু সিদ্ধযোগীগণ সর্বদাই পরমাত্মায় রমন করেন তাহাতে নিমগ্ন থাকেন।তাই সিদ্ধ যোগীরা সর্বদা ভগবানের আনন্দ অনুভব করতে পারেন। তাই তাদেরকে বিদ্বান বলা হয়েছে। "আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্"---------বিদ্বান ব্যক্তিরাই পরব্রহ্মের আনন্দকে অনুভব করেন।(তৈত্তিরীয় উপনিষদ..... ব্র০ ৪/১)।ভগবদ্পাদ শঙ্করাচার্য বিষ্ণুসহস্রনামের ৩৯৬ নাম "রাম" নামের ভাষ্যে উল্লেখ করেন- "নিত্যানন্দলক্ষণেহস্মিন্ যোগিন রমন্তং ইতি রামঃ।
রমন্তে যোগিনো নিত্যানন্দে চিদাত্মনি ইতি রামপদেনৈত ত্পরং ব্রহ্মাভিধীয়তে।। ইতি পদ্মপুরাণে; স্বেচ্ছায় রমণীয়ং বপুর্বহন্বা দাশরথী রামঃ।"-নিত্যানন্দস্বরূপ ভগবানে যোগীজন রমণ করেন, যার জন্য তিনি রাম।পদ্মপুরাণে বর্ণিত হয়েছে যে, যে নিত্যানন্দস্বরূপ চিদাত্মাতে যোগীজন রমন করেন ঐ পরব্রহ্ম "রাম" নাম পদে ভূষিত হোন।অথবা নিজ স্বেচ্ছায় রমণীয় শরীর ধারণকারী দশরথনন্দনই শ্রীরাম। যোগীজন সর্বদা ভগবানে রমণ(নিমগ্ন/যুক্ত) থাকেন বলে তিনি রাম নামে কথিত। তাই পদ্মপুরাণে শিবজী মাতা পার্বতীকে বলছেন যে তিনি সর্বদা রামনামে রমণ করেন। "রাম রাম রামেতি রমে রামে মনোরমে" (প০ উ০ ২৫৪/২০)-আমি এই রাম রাম নাম জপ করে এই মনোরম রাম নামে রমণ করি।তাই ভগবদ্পাদ শঙ্করাচার্য তার রচিত রঙ্গনাথাষ্টকম্ স্তোত্রে ভগবান রঙ্গনাথে বিভিন্ন লীলায় তাহার মন রমণ করেন। যা একজন প্রকৃত ভক্তই উপলব্ধি করতে পারেন।তিনি বলছেন- "শশাঙ্করূপে রমণীয়রূপে শ্রীরঙ্গরূপে রমতাং মনো মে" ॥১॥
অনুবাদ:পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরঙ্গনাথের রূপ চন্দ্রমার মতো শান্ত এবং উত্তম সৌন্দর্যময়(রমণীয় রূপ),ভগবান শ্রীরঙ্গনাথের দিব্যরূপে আমার মন রমণ করে(প্রসন্ন হয়)।

রাম শব্দে পরব্রহ্মে মনকে রমণ করাকেই আচার্যগণ বুঝিয়েছেন।যা ভগবানের সাথে নিত্যসম্বন্ধ স্থাপন করেন।যিনি ফলস্বরূপ সচ্চিদানন্দময় পরব্রহ্মের আনন্দ উপলব্ধি করতে পারেন যা ত্রিবিধ দুঃখকে নাশ করেন। শ্রীপরাশরভট্ট স্বামী তার বিষ্ণুসহস্রনামের রাম নামে ভাষ্য করেন- "রম্যতেহস্মিন সদা সর্বেঃ গুণরূপবশীকৃতঃ" ইতি রামঃ। যথা-১.রাম রময়তাং শ্রেষ্ঠঃ। ২. গুণাভিরামং রামং চ। ৩.শ্যামো যুবা লোহিতাক্ষো মাতঙ্গানামিব বর্ষভঃ। ৪.তথা সর্বপ্রজাকান্তেঃ প্রীতিসংজননৈঃ পিতুঃ। গুণেবিরুরুচে রামো দীপ্তঃ সূর্য ইবাংশুভিঃ।। ইতি। ৫.শরদিন্দীবরত্বিষে অভিরাম শরীররায়("রামমিন্দীবরশ্যামং" বা০ রা০, অ০ ২/৫৩)
। ইতি স্বমন্ত্রলিঙ্গাচ্চ। অনুবাদ: যিনি রমণ (আনন্দিত) করেন। তিনি হলেন রাম, "কারণ সকলেই তাঁর রূপ ও গুণাবলী দ্বারা মোহিত হয়ে সর্বদা আনন্দিত হয়"। "যিনি (সকল মানুষের মনকে) আনন্দ দেয় তাদের মধ্যে রামই অগ্রগণ্য/শ্রেষ্ঠ। রাম, যিনি তাঁর গুণাবলী দ্বারা মুগ্ধ করেন। রাম, শ্যামবর্ণের এবং লোহিতাক্ষ যুবক, যিনি স্রেষ্ঠ হস্তির ন্যায় দীপ্তিমান।সূর্যের মতো যে তার রশ্মির প্রভা জাজ্বল্যমান, রাম তার গুণাবলীর সহিত দেদীপ্যমান হোন যা তার রাজ্যের প্রজাদের মোহিত করেছিলেন এবং যা তার পিতার জন্য আনন্দের উৎস ছিলেন।যার দেহ শরতের ইন্দিবরের ন্যায় শ্যামবর্ণ এবং অভিরাময় (কমনীয়) শরীর।এটি তাঁর সম্পর্কে মন্ত্র দ্বারাও প্রতিভাসিত হয়। "রাম রময়তাং শ্রেষ্ঠ" (বাল্মীকি রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, ৫৩/১)-আনন্দদানকারীদের মধ্যে রামই শ্রেষ্ঠ,
"গুণাভিরামং রামং চ" ( বা০ রা০, সু০, ১৬/১)- শ্রীরামচন্দ্র তাহার পরিপূর্ণ গুণদ্বারা আনন্দদান করেন। "কথমিন্দীবরশ্যামং দীর্ঘবাহুং মহাবলম্ অভিরামহহং রামং" (বা০ রা০, অ০ ১৩/১০)- শ্রীরাম নীলপদ্মের ন্যায় শ্যামল, আজানুলম্বিত বাহু, মহাবলশালী, আনন্দদানকারী।
"রাম লোকাভিরামো" (বা০ রা০, অ০ ২/৪৪)- রাম লোকসমূহের আনন্দদানকারী।

"তথা সর্বপ্রজাকান্তৈঃ প্রীতিসঞ্জননৈঃ পিতু।
গুণৈর্বিরুরুচে রামো দীপ্তঃ সূর্য ইবাংশুভিঃ।।" (বা০ রা০, অ০ ১/৩৩)

অনুবাদ: প্রজাসকলের মনোরঞ্জন ও পিতার প্রীতিকর কার্যগুণে রাম স্বীয় কিরণমালায় প্রোজ্জ্বল সূর্যের মতো প্রদীপ্ত (সকলের আকর্ষণীয়) হয়ে উঠেছিলেন।

"দান্তৈঃ সর্বপ্রজাকান্তৈঃ প্রীতিসংজননৈর্নৃণাম্।
গুণৈর্বিরোচতে রামো দীপ্তঃ সূর্য ইবাংশুভিঃ।। ( বা০ রা০, অ০ ২/৪৭)

অনুবাদ: কিরণরাশি দ্বারা প্রদীপ্ত সূর্যের ন্যায় স্বীয় ইন্দ্রিয় দমন ও প্রজাদের প্রীতি(আহ্লাদ আনন্দদের)উৎপাদন দ্বারা কমনীয়তা গুণে রামচন্দ্র সুশোভিত।
অর্থাৎ, ভগবান রাম আপ্রাকৃত কল্যাণগুণ দ্বারা লোকসমূহের আনন্দদাতা বিধায় তিনি রাম নামে অভিহিত। অতএব আচার্যগণের ভাষ্যানুসারে পরব্রহ্মকে রাম নামে অভিহিত করার মূলত দুটি কারণ। প্রথমত রাম যিনি অন্যকে আনন্দদান করেন, দ্বিতীয়ত রাম তিনি যাহাতে সবলোকমূহ আনন্দ উপভোগ করেন।"স উত্তমঃ পুরুষঃ।স তত্র পর্য্যেতি জক্ষৎ ক্রীড়ণ রমমানঃ স্ত্রীভির্বা যানৈর্বা জ্ঞাতিভির্বা" (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৮/১২/৩)
অনুবাদ:-এই সেই উত্তমপুরুষ, তিনি স্ত্রী বা জ্ঞাতিগণে (পার্ষদগণ) সঙ্গে বা যানে(বাহনে) আরোহন করে হাস্য করে বা ক্রীড়া করে রমণ করে( আনন্দকরতঃ) বিচরণ করেন।অর্থাৎ ভগবান বিষ্ণু রাম নামে অভিহিত হয়ে জীবসকলে রমণ করেন এবং জীবসকল ভগবান রামে রমণ করেন যার ফলস্বরূপ সচ্চিদানন্দের আনন্দকে প্রাপ্ত হয়।মূলত ইহাই পরব্রহ্মকে রাম শব্দে সম্বোধিত করার মূল কারণ।
👉"কৃষ্ণসংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারে কৃষ্ণ শব্দটির মূলত "কৃষ্" ধাতু থেকে উৎপত্তি। √কৃষ্(আকর্ষণ করা)+ণ প্রত্যয় ক’রে ‘কৃষ্ণ’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়।(কর্ষতি ইতি কৃষ্ণঃ)। অর্থাৎ যে সত্তা মহাবিশ্বের সব কিছুকে নিজের দিকে আকর্ষণ করছে। বৈদিক নিরুক্ত কোষে(২/৬) কৃষ্ণ শব্দে বলা হয়েছে- "কৃষ্ণবর্ণ রাত্রিঃ। কৃষ্ণং কৃষ্যতেঃ, নিকৃষ্টো বর্ণঃ।" অর্থাৎ, কালো অসিতবর্ণই রাত। কৃষ্ণ যে আকর্ষণ করে, যাহা নিকৃষ্ট বর্ণ (অন্যান্য বর্ণ থেকে যাহা অনুজ্জ্বল বা অপকৃষ্ট)।নিরুক্ত অনুসারে "কৃষ্ণ" শব্দের অর্থ, যে সত্ত্বার বর্ণ রাত্রির ন্যায় অপকৃষ্ট অসীতবর্ণ যিনি নিজদিকে আকর্ষণ করেন। এবার আমরা দেখে নেই ভগবান কৃষ্ণ মহাভারতের কৃষ্ণ শব্দের অর্থ কি বলেছেন-

"কৃষামি মেদিনীং পার্থ! ভূত্বা কার্ষ্ণায়সো মহান্।
কৃষ্ণবর্ণশ্চ মে যস্মাত্তস্মাৎ কৃষ্ণোহহমর্জ্জুনম।।" ( মহাভারত, শান্তিপর্ব, ৩২৮/২৬৫)

অনুবাদ: পৃথানন্দন অর্জুন! আমি লাঙ্গলের বিশাল লৌহময় ফাল হইয়া ভূমিকে কর্ষণ(আকর্ষণ) করি; অথবা যেহেতু আমার কৃষ্ণবর্ণ সেই হেতু আমি কৃষ্ণ।
অতএব, ভগবান কৃষ্ণ নিরুক্ত অভিধানের ন্যায়ই উক্তি করেন।যে তিনি ভূমিকে আকর্ষণ এবং তাহার বর্ণ কৃষ্ণ বিধায় তিনি কৃষ্ণ নামে খ্যাত।তাছাড়াও মহাত্মা সঞ্জয় মহাভারতে কৃষ্ণ শব্দের আরেকটি অর্থ করেছেন। যে সত্তার মধ্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল আনন্দ বিদ্যমান তিনিই কৃষ্ণ।

"কৃষির্ভূবাচকঃ শব্দো ণশ্চ নির্বৃতিবাচকঃ।
কৃষ্ণস্তদ্ভাবযোগাচ্চ কৃষ্ণো ভবতি সাত্ত্বতঃ।।" (মহাভারত, উদ্যোগপর্ব ৬৬/৫১)

অনুবাদ: কৃষ্ ধাতু অর্থ সত্তা এবং ণ শব্দের অর্থ আনন্দ; এই উভয়ই তাহাতে আছে বলিয়া যদুবংশীয় কৃষ্ণ "কৃষ্ণ" নামে অভিহিত হইয়া থাকেন।
অর্থাৎ, ভগবান কৃষ্ণ নিজে পরব্রহ্ম সত্তা যার মধ্যে চিন্ময় আনন্দ বিদ্যমান তাই কৃষ্ণ শব্দে তিনি বিখ্যাত। পরব্রহ্ম সদাই আনন্দময় সত্তা। তিনি আনন্দের উৎস এবং যোগীমহাত্মাগণ সেই আনন্দই উপভোগ করেন। তিনি স্বভাবতই আনন্দময়।ইহাই বেদান্তে বর্ণিত। -
"ওঁ আনন্দময়োহভ্যাসাৎ" (বেদান্তসূত্র ১/১/১২)- পরমেশ্বর ভগবান স্বভাবতই আনন্দময়।
শ্রীপরাশরভট্ট স্বামী তার বিষ্ণুসহস্রনামের ৫৮ এবং ৫৫৪ নং "কৃষ্ণ" নামের ভাষ্যে বলেন- "এবংবিধ-লীলারসেন নিতান্ত- নিবৃত্তঃ কৃষ্ণ।"- তাহাকে কৃষ্ণ বলে সম্বোধন করা হয় কারণ এইপ্রকার লীলারস দ্বারা তিনি অত্যধিক প্রসন্ন হোন। "তন্ময়-মেঘমেচক-চারুবর্ণঃ কৃষ্ণঃ। কৃষ্ণবর্ণং ইতি তক্প্রত্যয়ঃ। তন্ময়রূপ এব বারাহাদ্যবতারহপি ইতি চ নিরুচে।'- সেই পরব্রহ্ম কৃষ্ণ কারণ তাহার মধ্যে শুদ্ধসত্ত্ব এক অপ্রাকৃত শরীর বিদ্যমান যাহাতে গাঢ় মেঘের ন্যায় আকর্ষক সুন্দরবর্ণ প্রতিভাসিত।" কৃষ' (আকর্ষণ করা) ক্রিয়াপদটির পরে 'নক' প্রত্যয়টি আসে যখন এর অর্থ একটি বর্ণ(রং)।" (কৃষ্+নক-কৃষ্ণ)।ভগবানের দেহ তাঁর অবতারে বরাহ এবং অনুরূপ একই উপাদান (সুদ্ধ-সত্ত্ব) দ্বারা গঠিত।অতএব, ভগবান বিষ্ণু তার রূপ,গুণ,লীলা দ্বারা তার ভক্তগণকে আর্কষণ করেন এবং তার ঘনমেঘশ্যামের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ বিধায় তিনি "কৃষ্ণ" নামে অভিহিত।
এবার, দেখা যাক বেদশাস্ত্রে কোথায় পরব্রহ্ম ভগবান বিষ্ণুকে কৃষ্ণ নামে অভিহিত করা হয়েছে। সামবেদোক্ত ছান্দোগ্য উপনিষদে যজ্ঞপুরুষ ভগবান বিষ্ণুকে দেবকীপুত্র কৃষ্ণ নামে সম্বোধন করা হয়েছে।
"তদ্ধৈতদ্ ঘোর আঙ্গিরসঃ কৃষ্ণায় দেবকীপুত্রায় উক্ত্বা উবাচ। অপিপাস এব স বভূব। সোহন্তবেলায়ামেতত্রয়ং প্রতিপদ্যেত। অক্ষিতমস্যচ্যুতমসি প্রাণসংশিতমসীতি। তত্রৈতে দ্বে ঋচৌ ভবতঃ" (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৩/১৭/৬)
অনন্তাচার্য্যের ব্যাখ্যানুসার অন্বয়: তদেতৎ-পুরুষযজ্ঞ দর্শনম্-পুরুষ যজ্ঞের জ্ঞান, কৃষ্ণায়- কৃষ্ণশেষভূতং তৎ প্রীত্যর্থম্- জগতের মূল ভগবান কৃষ্ণের প্রীতির জন্য, ইত্যুক্তুবা- অনুসন্ধায়-তাহাকে অনুসন্ধান করে, উবাচ- অনুষ্টিতবান্-এই পুরুষযজ্ঞের উপাসনার দ্বারা, অপিপাস- মুক্তঃ- তিনি পিপাসাবিহীন হয়েছিলেন, অন্তবেলায়ম্-তার জীবনের অন্তিম সময়ে,
পূর্বে বর্ণিত মন্ত্রের পুরুষযজ্ঞ দর্শনের সাথে তুলনা করলে যে একশত ষোল বছর আয়ু হয় এই ধরনের ধ্যান ব্রহ্ম বিদ্যা লাভের জন্য উপযোগী।
অক্ষিতমসি-ক্ষয়শূণ্যমসি-তুমি অক্ষয়, অচ্যুতমসি- স্বরূপ স্বভাব প্রচ্যুতি শূণ্যমসি- আপনিই সেই যিনি স্বরূপস্বভাবে বিচ্যুত কখনও হোন না। প্রাণসংশিত মসি- জগৎ প্রাণয়িতৃত্ব সতি সুক্ষ্ম তত্বমসি- আপনি সেই তত্ত্ব যিনি প্রাণবায়ুর কার্য নিয়ন্ত্রণ করেন এবং একই সাথে সূক্ষ্মতত্ত্ব।যাহা পরব্রহ্মকে সম্বোধন করা হয়..
অনুবাদ: দ্রষ্টা ঘোর- আঙ্গিরস পুরুষযজ্ঞকে সমর্পণের সহিত দেবকীনন্দন কৃষ্ণের অধীনস্থে প্রীতির নিমিত্তে উৎসর্গ করেছিলেন। যাতে ঘোর আঙ্গিরসের কোনো তৃষ্ণা ছিলো না।কারণ তিনি এর মাধ্যমে ব্রহ্মবিদ্যা অর্জন করেছিলেন। তার জীবনের অন্তিম সময়ে তিনি ব্রহ্মকে বলেন- "আপনি অক্ষয়(শ্বাশত), আপনি অচ্যুত(কল্যাণগুণে পরিপূর্ণ) , আপনি প্রাণসংশিত(আপনি ব্রহ্মাণ্ডকে জীবনদানকারী সুক্ষ্ম সত্য)।এই বিষয়ে দুটি ঋক রয়েছে।
মূল উপনিষদে কিন্তু কৃষ্ণ যে ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য। তার কোনো উল্লেখনেই। শঙ্করাচার্য্য তার ভাষ্যব্যাখ্যায় বলেছেন "কৃষ্ণায় দেবকীপুত্রায় শিষ্যায়"। তাই থেকে অনেক পন্ডিতেরাও তাই ধারনা করেন। কিন্তু "দেবকীপুত্র কৃষ্ণ" কৃষ্ণের পরিচয়ের জন্য এটাইকি যথেষ্ট নয়?

👉রঙ্গরামানুজাচার্য্য তার ছান্দোগ্য উপনিষদের ভাষ্যে এই মন্ত্রের যে ব্যাখ্যা করেছেন তা দেওয়া হল-

"স ঘোরনামা ভগবচ্ছেষত্বানুসন্ধানপূর্বক পুরুষ যজ্ঞোপাসনানুষ্ঠানেন ব্রহ্মবিদ্যাং প্রাপ্যাপিপাসো মুক্তো বভূবেত্যর্থঃ। ততশ্চ ষোড়শাধিকবর্ষশতজীবন
ফলকস্যাপি পুরুষযজ্ঞদর্শনস্য ভগবচ্ছেষত্বানুসন্ধান পূর্বকমনুষ্ঠিতস্য ব্রহ্মবিদ্যোপযোগীত্বমপ্যস্তীতি ভাবঃ। স বভূবেত্যস্য স ভবতীত্যর্থঃ। সোহন্তবেলায়ামিত্যত্র স ইত্যস্য য ইত্যর্থঃ। ততশ্চ যোহন্ত বেলায়ামেতত্রয়ং প্রতিপদ্যেত সোহপিপাসো ভবতীত্যুবাচেত্যুত্তরত্রাণ্বয়ঃ। স ভগবচ্ছেষত্বানুসন্ধান পূর্বকপুরুষবিদ্যাসাধিত চিরায়ুষ্ট্বানুগৃহীত ব্রহ্মবিদ্যানিষ্ঠ পুরুষঃ। মরণকাল এতন্মন্ত্রত্রয়ং জপেদিত্যর্থঃ। তত্র পরব্রহ্মবিষয় এতাবৃঙ্মন্ত্রৌ ভবতঃ।।"

অনুবাদ:- পুরুষযজ্ঞদ্রষ্টা অঙ্গিরস গোত্রীয় ঘোর নামক ঋষি দেবকীনন্দন শ্রীকৃষ্ণের প্রীতীর জন্য এই ব্রহ্মবিদ্যা অনুসন্ধান করে সেই পুরুষযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেই ঘোর নামক ঋষি ভগবানের শেষত্ব অনুসন্ধান করে পুরুষযজ্ঞোপাসনা দ্বারা নিশ্চই নিবৃত্ততর্ষ বা জড়তৃষ্ণামুক্ত হয়েছিলেন। অন্তিমকালে যিনি এই মন্ত্রত্রয়ের শরণ নেয় তিনি মুক্ত হন। প্রয়াণকালে এই তিন মন্ত্র জপ করা কর্তব্য হে পরব্রহ্ম তুমি অক্ষয়, তুমি অচ্যুত, তুমি প্রাণের থেকেও প্রিয়তম। এই বিষয়ে দুটি ঋক আছে।
ভগবান যজ্ঞপুরুষ বিষ্ণুকে দেবকীনন্দন কৃষ্ণ নামে অভিহিত করা হয়েছে। কারণ ভগবান বিষ্ণু যেমন যজ্ঞপুরুষ (১/৩/৪)

"বৈষ্ণবো ভবতি বিষ্ণুর্বৈযজ্ঞ স্বয়মেবৈনং
তদ্দেবতয়া স্বেন চ্ছন্দসা সম্বর্দ্ধয়ত" (ঐ০ ব্রা০ ১/৩/৪)

অনুবাদ: (সেই পুরোডাশ) বিষ্ণুর জন্য অভিলষিত, বিষ্ণুই যজ্ঞ, সেই বিষ্ণু স্বয়ং আপনারই দেবতা দ্বারা ও আপনারই ছন্দোদ্বারা যজ্ঞকে সমৃদ্ধ করা হয়।
তেমনি ভগবান কৃষ্ণও যজ্ঞভোক্তা।"অহম হি সর্ব যজ্ঞানাং ভোক্তা"(গীতা ৯/১৪)অনুবাদ:- আমিই সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা ও প্রভূ। "ভোক্তারং যজ্ঞ তপসাং সর্ব লোক মহেশ্বরং" (গীতা ৫/২৯)অনুবাদ:- আমাকে সমস্ত যজ্ঞ ও তপস্যার পরম ভোক্তা সর্বলোকের মহেশ্বর....তাই উক্তমন্ত্রে কৃষ্ণও যজ্ঞপুরুষ।বেদোক্ত ভগবানের গুণ ও কর্ম অনুসারে তিনি বিভিন্ন নামে ভূষিত হোন।
সে সম্পর্কে মহাভারতে বলা হয়েছে- "গৌণানি তত্র নামানি কর্ম্মজানি চ কানিচিৎ" ( মহা০ শা০ ৩২৭/১০)- আমার সেই নামগুলোর মধ্যে কতোগুলো গুণানুসারে কতো কর্মানুসারে উৎপন্ন। ভগবানের এই সব নামই বেদে এবং পুরাণে গুপ্তরূপে বিদ্যমান।

"যানি নামানি তে দেব। কীর্ত্তিতানি মহর্ষিভিঃ।
বেদেষু সপুরাণেষু যানি গুহ্যনি কর্ম্মভিঃ।।" (মহা০ শা০ ২৭২/৬)

অনুবাদ: হে কেশব! মহর্ষিরা আপনার যেসকল নাম কীর্তন করিয়াছে এবং কীর্তি(কর্ম) অনুসারে উৎপন্ন আপনার যে সকল নাম বেদ ও পুরাণে গুপ্ত রহিয়াছে।
অর্থাৎ বেদশাস্ত্রে দেবকীনন্দন কৃষ্ণ, রাম আদি শব্দে যদুবংশী দেবকীনন্দন কৃষ্ণ ও দাশরথি আনন্দদাতা রামকেই নির্দেশ করছে।কারণ যে বিশেষ্য বা সর্বনাম ক্রিয়া সম্পন্ন করেন তিনি ক্রিয়ার কর্তা। আর এই ক্রিয়া অনুসারে কর্তা বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়।যেমন- অনেক খেতে পারে বলে সে পেটুক, অনেক সুন্দর নাচতে পারে বলে সে নাট্যকার।তদ্রুপ বেদের ভগবান তার বিভিন্ন ইতিহাসপুরাণে বিভিন্ন প্রত্যক্ষকীর্তির জন্য বেদে বিভিন্ন নামে অভিহিত। তিনি আনন্দদাতা বলিয়া রাম, সর্বাকর্ষক বলিয়া কৃষ্ণ ইত্যাদি নামে অভিহিত। তাই ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন-

"ঋগ্বেদে সযজুর্ব্বেদ তথৈবাথর্ব্বসামসু।
পুরাণে সোপনিষদে তথৈব জ্যোতিষেহর্জ্জুন!।।
সাংখ্যে চ যোগশাস্ত্রে চ আয়ুর্ব্বেদে তথৈব চ।
বহুনি মম্ নামানি কীর্ত্তিতানি মহর্ষিভিঃ।।" (মহা০ শা০ ২২৭/৮-৯)

অনুবাদ: ভগবান্ বলিলেন—'অৰ্জ্জুন! ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথৰ্ব্ববেদ, পুরাণ, উপনিষৎ, জ্যোতিষ, সাংখ্য, যোগ ও আয়ুর্ব্বেদশাস্ত্রে মহর্ষিা আমার বহুত্তর নাম কীর্ত্তন করিয়াছেন।
তাছাড়া বেদশাস্ত্রকে ইতিহাস ও পুরাণ দ্বারাই বর্ধিত করতে হবে। বেদশাস্ত্রের ভগবানের বিভিন্ন নাম ইতিহাস ও পুরাণ দ্বারা ব্যাখ্যা করতে হবে। কারণ ইতিহাস ও পুরাণ পঞ্চম বেদ।"ইতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদম্‌" (ছা০ উ০ ৭/১/২)।তাই মন্ত্রজ্ঞানকে চরিতার্থ করতে ইতিহাসপুরাণ অবশ্যই দরকার।

"ইতিহাসপুরাণাভ্যাং বেদং সমুপবৃহংহয়েৎ।
বিভেত্যতল্পশ্রুতাদ্বেদো মাময়ং প্রহরিষ্যতি।।" (মহা০ শা০ ১/২২৯)

অনুবাদ: ইতিহাস ও পুরাণ দ্বারা বেদকে বর্ধিত করিবে, না হইলে 'এ আমাকে প্রহার করিবে' ইহা ভাবিয়া বেদ অল্পজ্ঞ লোক হইতে ভয় পাইয়া থাকেন।
ইতিহাস পুরাণ নিয়ে বেদ গঠিত হয়েছে। তাই বেদোর সূত্রাকার মন্ত্রগুলোর ব্যাখ্যায় অবশ্যই ইতিহাস পুরাণের ব্যাখ্যা দরকার। ইতিহাস পুরাণ বেদের অঙ্গ।সে সম্পর্কে গোপথব্রাহ্মণে বলা হয়েছে-

"এবমিমে সর্বে বেদা নির্মিতাঃ সংকল্পাঃ সরহস্যাঃ সব্রাহ্মণঃ সোপনিষৎকাঃ সেতিহাসাঃ সান্বাখ্যাতাঃ সপুরাণাঃ সস্বরাঃ" (গোপথ-ব্রাহ্মণ,পূর্বভাগ, ২/৯)

অনুবাদ: “এইভাবে কল্প, রহস্য, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ, ইতিহাস, অন্বাখ্য,পুরাণ, স্বর প্রভূৃতি সহ সমস্ত বেদ প্রকাশিত হয়েছিল।”
ভগবদ্পাদ রামানুজাচার্যও তার বেদার্থ-সংগ্রহ গ্রন্থে বলেন বেদের নিগুঢ় তত্ত্ব ইতিহাসপুরাণ শাস্ত্রের দ্বারাই বোধগম্য হয়।তাই বেদমন্ত্রের বিশ্লেষণে অবশ্যই ইতিহাস পুরাণের প্রয়োজন।
“বেদানামনগুত্বাৎ দুরবগাহতাচ্চ পরমপুরুষনিযুক্তাঃ পরমর্যয়ঃ কল্পে কল্পে নিখিলজগদুপকারার্থং বেদার্থং স্মৃত্বা, বিধ্যর্থবাদমন্ত্রমূলানি ধর্মশাস্ত্রাণি ইতিহাসপুরাণানি চ চকুঃ৷”
(বেদার্থসংগ্রহ, ২৩২, শ্রীপাদ রামানুজাচার্য)

অনুবাদ: বেদ অনন্ত বলে এবং দুর্বোধ্য বলে পরমপুরুষ কর্তৃক নিযুক্ত পরম ঋষিগণ কল্পে কল্পে নিখিল জগতের উপকারের জন্য বেদের অর্থ স্মরণ করতঃ বিধি-অর্থবাদ ও মন্ত্রমূলক ধর্মশাস্ত্রসমূহ (মনুস্মৃতি আদি..), ইতিহাস (মহাভারত, রামায়ণ), পুরাণসমূহ(বিষ্ণু-ভাগবতাদি) রচনা করেছেন।
এখন কিছু সমাজীরা বলে বেদে অনিত্য কিছু কাহিনি কথাবার্তা উল্লেখ থাকতে পারে না। কারণ বেদ নিত্য।তবে প্রশ্ন উঠে বেদ তবে প্রলয়কালে অদৃশ্য হয়ে কোথায় অবস্থান করে তাহলে তো বেদও অনিত্য কারণ তখন তাহা প্রত্যক্ষদর্শিত হয় না।তদ্রুপ ভগবানের যুগে যুগে লীলা সমূহকে অনিত্য আমরা ধরতে পারি না।কারণ আমাদের চোখে সূর্যের দর্শন অদর্শন কখনও তাহার উদয়অস্ত বিচার করতে পারে না।সে তার সঠিক সময়েই দর্শনযোগ্য হয়।

"যৈর্বত্র দৃশ্যতে ভাস্বান তেষামুদয়ঃ স্মৃতঃ।
তিরোভাবঞ্চ যত্রৈতি তত্রৈবাস্তমনং রবে।।
নৈবাস্তমনমর্কস্য নোদয়ঃ সর্ব্বদা সতঃ।
উদয়াস্তমনাখ্যং হি দর্শনাদর্শনং রবেঃ।।"
(বিষ্ণুপুরাণ,২/৮/১৪-১৫)

অনুবাদ:হে ব্ৰহ্মন্ ! দিক্‌বিদিক্ সমুদয়েই এইরূপ। যাহারা যেখানে সূর্য্যকে নিশাবসানে দেখিতে পায়, তাহাদের পক্ষে তাহা সূর্যোদয় এবং যেখানে সূৰ্য্য অদৃশ্য হন, সেই স্থলেই তাঁহার অস্ত কথিত হয়। সর্ব্বদা বর্ত্তমান সূর্যের উদয় ও অস্ত নাই ; রবির দর্শন ও অদর্শনই উদয় ও অস্ত নামে কথিত৷
ঠিক সেভাবেই ভগবান তাহার কল্পে কল্পে লীলাসমূহ সেই লীলার তার সেই কল্পানুসারে করে থাকেন।যেমন বৈবস্বত মন্বন্তরে মৎস্যলীলা, বরাহকল্পে বরাহলীলা, ত্রেতাযুগের অন্তিমে রামলীলা, অষ্টাবিংশতি দ্বাপরযুগে শেষে যদুবংশীয় কৃষ্ণলীলা, কলিযুগের অন্তিমে কল্কি অবতার। এরকম বিভিন্ন অবতারের বিভিন্ন কল্পযুগ বিভক্ত থাকে।তাই বলে আমাদের দর্শন তাহার অনিত্য বিচার করে না।কোনো একটি "আমি প্রতিদিন ভাই খাই" এটি নিত্যবৃত্ত বর্তমান কাল।তদ্রুপ কেউ হঠাৎ আমার বাড়িতে এসে আমাকে খেতে দেখলো না বলে যে আমি ভাই খাই না তা নয়।কারণ আমি আমার সঠিক সময়ে ঠিকই ভাত খাই।কারণ তাহা প্রতিদিনই ঘটে তাই নিত্য।তদ্রুপ ভগবান তার অবতারের অবতরণ সঠিক কল্পে কল্পে সঠিক সময়ে ঠিকই করেন।তাই আমাদের দর্শন তাহাকে অনিত্য বলতে পারে না।কারণ তা অনাদি কাল থেকে সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের মাধ্যমে এই সব লীলা সমূহ কল্পে কল্পে চলেছে। কল্পের বাহিরে দূর্লভ মহাত্মাগণ পরব্রহ্মের সেই লীলারসকে হৃদয়াকাশে উপলদ্ধি ও আস্বাদন করতে পারেন যদি তাহার প্রতি পরব্রহ্মের অনুগ্রহ বজায় থাকে।

"নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন ।
যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্য-স্তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুতে তনুং স্বাম্ ।।" (মুণ্ডক উপঃ ৩/২/৩ এবং কঠ উপঃ ১/২/২৩)

অনুবাদঃ- দক্ষ প্রবচনের দ্বারা, গভীর মেধার দ্বারা, এমন কি বহু শ্রবণের দ্বারাও পরমেশ্বর ভগবানকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ভগবান যাকে নির্বাচিত এবং পছন্দ করেন, তিনিই কেবল তাঁকে জানতে পারেন। সেই রকম ভক্তের কাছে ভগবান স্বয়ং নিজের স্বরূপ প্রকাশ করেন।
অতএব, বেদসমূহমে ভগবান বিষ্ণুকে তার অবতার লীলা,গুণ,কর্মানুসরে রাম, কৃষ্ণ আদি নামে অভিহিত করা কোনো আশ্চর্যজনক ব্যাপার নয়।কারণ তিনিই যে ব্রহ্মাণ্ডের কালচক্রের নিয়ন্ত্রা এবং সেই কালচক্র সেই ভগবান বিষ্ণুই অস্ত্র।

"চতুর্ভিঃ সাকং নবতিং নামভিশ্চক্রং ন বৃত্তং ব্যতীরবীবিপৎ।
বৃহচ্ছরীরো বিমিমান ঋক্কভির্ষুবাকুমারঃ প্রত্যেত্যহিবম্।।"
(ঋগ্বেদ ১/১৫৫/৬)

অনুবাদ:সূর্যস্বরূপ ভগবান বিষ্ণু চার সহিত তত্ত্ব অর্থাৎ চুরানব্বই কাল গণনার অবয়বকে [১ সংবতসর (বর্ষ), ২ অয়ন (উত্তরায়ণ দক্ষিণায়ণ), পঞ্চঋতু, দ্বাদশ মাস,২৪ পক্ষ (শুক্ল এবং কৃষ্ণ), ৩০ দিন-রাত্রি, ৮যম, ১২ মেষ বৃশ্চিকাদি রাশি, কাল গণনার মোট ৯৪ উপাদান রয়েছে] স্বীয় প্রেরণশক্তির দ্বারা চক্রাকার (গোল চক্রের ন্যায়)রূপে ঘুর্নায়মান। বিশাল স্বরূপধারী,সদা যৌবনরূপ,কখনও যিনি ক্ষীণ(শক্তিহীন) হোন না,সূর্যস্বরূপ বিষ্ণুদেব কালের গতিকে প্রেরিত করে স্তব এর দ্বারা আহ্বান করার পর যজ্ঞে গমন করেন(অর্থাৎ সৃষ্টিক্রমের বিরাট যজ্ঞ সম্পন্ন করছেন)।

এই কালচক্র সাক্ষাৎযজ্ঞপুরুষ ভগবান বিষ্ণুর আয়ুধ।"কালচক্রনিজায়ুধং সাক্ষাদ্ভগবন্তং" (ভাগবতম্ ৫/১৪/২৯)।তাই বাল্মিকী রামায়ণে ত্রেতায় রামকে কৃষ্ণ নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং দ্বাপরযুগে ভগবান কৃষ্ণ বিশ্বরূপে তিনি অস্ত্রধারীদের মধ্যে রাম।আর সর্বাবতার মূল ভগবান নারায়ণ তার গুণ,কর্ম অনুসারে এসব নামে ভূষিত হোন।ভগবান বিষ্ণু কালচক্র যাহার অস্ত্র কালচক্রের যিনি নিয়ন্ত্রা আর জীব কালচক্রের অধীন,এখন সেই কালচক্রের অধীনস্থ জীব যদি তার অধীনস্থ জ্ঞান দ্বারা কালচক্রের নিয়ন্ত্রকের লীলাকে বিচার করেন তবে তাহার নিছকই হাস্যকর।কারণ ভগবান কালেরও উর্দ্ধে।
সুতরাং, উপরের পর্যালোচনা থেকে বুঝা যায় যে "হরেকৃষ্ণ হরেরাম " ষোড়াক্ষর মন্ত্র কোনো অবৈদিক নয়।তাহা বেদোক্ত পরব্রহ্ম ভগবান বিষ্ণুই কল্যাণগুণ ও দিব্যলীলা অনুসারে তাহার দিব্যনাম।যাহা জপ বা কীর্তন মূলত ভগবান বিষ্ণুরই যশ-মহিমা কীর্তন।যদি তিনটি শব্দ তথাপিও ভগবান বিষ্ণুর শব্দত্রয়ের মন্ত্র বহুমহিমা লুকায়িত।যা কলিসন্তরণ উপনিষদে ছন্দবদ্ধভাবে রচিত।তাই যিনি ভক্তিসহকারে এই নামত্রয় কীর্তন করেন তা বিষ্ণুর প্রীতির কারণ হয়,ভক্তি কখনও বিফল হয় না।যা সংসাররূপ মহাভয় থেকে পরিত্রাণ করে বিষ্ণুর পরমপদ প্রাপ্ত হোন।কারণ ভগবান কৃষ্ণ গীতা অর্জুনকে এই উপদেশ দান করেছিলেন।
"নেহাভিক্রমনাশোস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে৷
স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াত্৷৷" (গীতা ২/৪০)

অনুবাদ: ভক্তিযোগের অনুশীলন কখনও ব্যর্থ হয় না এবং তার কোন ক্ষয় নাই। তার স্বল্প অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠান দাতাকে সংসাররুপ মহাভয় থেকে পরিত্রাণ করে।